https://kalbela.com/ajkerpatrika/joto-mot-toto-path/0dzomub0p8

সুরক্ষার আইন যেন গলার কাঁটা না হয়

আঙ্গুর নাহার মন্টি

Published on: 9 Mar, 2023, 8:59 am

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। ইন্টারনেট ও ডিজিটাল প্রযুক্তি মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করছে। আর এক নিমেষে তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা দুনিয়ায়। সাংবাদিকতায়ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। কারণ মানুষ এখন সকালে সংবাদপত্র ও সন্ধ্যায় রেডিও-টেলিভিশনের খবরের অভ্যাস পেরিয়ে হাতের মুঠোয় স্মার্ট ফোনে প্রতিমুহূর্তে পুরো বিশ্বের তথ্য জানতে পারছে। শুধু তা-ই নয়, সঙ্গে সঙ্গেই নিজের মতামতও প্রকাশ করছে। তাই পাঠক-দর্শক-শ্রোতা (অডিয়েন্স) ধরে রাখতে দ্রুত তথ্য দেওয়া নিয়ে মূল ধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা লেগেই আছে। এমন বাস্তবতায়ও পুরোনো ও নতুন আইনের মাধ্যমে সেন্সরশিপ এবং বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণের কারণে মতপ্রকাশ ও তথ্যপ্রাপ্তির স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা ও সুরক্ষাও লঙ্ঘিত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, মূল ধারার গণমাধ্যমের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাও কমছে। ফলে কঠিন এক সময় পার করছে দেশের গণমাধ্যম। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিতের পাশাপাশি সেন্সরশিপ এবং বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে নাগরিকদের বাক ও ভাব প্রকাশের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্র যুক্তিসংগত বিধিনিষেধের মাধ্যমে ৩৯ অনুচ্ছেদের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এমনটাও সংবিধানে বলা হয়েছে।

অফিশিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট ১৯২৩, পেনাল কোড ১৯৬০ (ধারা ৪৯৯-মানহানি), ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ (ধারা ৯৯, ১০৮, ১৪৪), প্রিন্টিং প্রেস ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধন) আইন, ১৯৭৩, প্রেস কাউন্সিল (সংশোধন) আইন, সংবাদপত্র কর্মচারী (পরিষেবার শর্ত) আইন ১৯৭৪, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন ২০০৬, আদালত অবমাননা আইন ২০১৩, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ২০১৮, ডিজিটাল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) রেগুলেশন ২০২১, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান ও পরিচালনা নীতিমালা ২০২১, গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন ২০২২ (খসড়া) এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইন ২০২২-সহ বাংলাদেশে পুরোনো ও নতুন সব আইনই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাংবাদিকতাকে প্রভাবিত করে।

 

বাংলাদেশে মিডিয়া লিটারেসি ও ডিজিটাল লিটারেসি সম্পর্কে ধারণা ছাড়াই আমরা যেন অজানা গন্তব্যে এগিয়ে চলেছি। নিয়ন্ত্রণমূলক আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কারণে প্রপাগান্ডার মতোই সেন্সরশিপ নেতিবাচক অর্থে রূপান্তরিত হচ্ছে। আমরা অফলাইন বা অনলাইন সবখানেই সহিষ্ণু সমাজের প্রতিফলন দেখতে চাই। অথচ ভিন্নমতের প্রতি সম্মান রেখে নিজের মতপ্রকাশের চর্চার পরিবেশ তৈরির কথা যেন কারও মাথাতেই নেই। ফলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও বাস্তবজীবনে অসহিষ্ণুতা ও হতাশা ভর করছে।

যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, আইনগুলো সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নয়। তবে গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজ ও উন্নয়ন সহযোগীদের অভিমত, এসব আইন মুক্ত ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করছে। বিশেষ করে ডিএসএ সেলফ সেন্সরশিপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইন একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণমূলক ও মানুষের গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুণ্ন করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনকি এ আইনগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধী ও ভিন্নমত দমনে ব্যবহারের আশঙ্কার কথাও বলা হচ্ছে। সম্প্রতি ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বর্তমান সরকার সংবিধান ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিপন্থি কোনো আইন করবে না এমন আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বা বাক-স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য করা হয়নি। এটা সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ ও দমন করার জন্য করা হয়েছে। সাইবার অপরাধ দমনে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কতটা সফল তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। দেশের বাইরে থেকে গুজব ও হয়রানিমূলক কনটেন্টগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারার অসহায়ত্ব প্রতিনিয়তই অনুভব করছি।

এই যে এত বড়সংখ্যক বাংলাদেশি ফেসবুক-ইউটিউবে বুঁদ হয়ে আছে, তারা কি শুধু নির্বিঘ্নে যোগাযোগই করছে? না, তারা সামাজিক আন্দোলনের বড় শক্তি হিসেবেও কাজ করে। ভালো উদাহরণ শাহবাগ আন্দোলন তো আমাদের চোখের সামনেই আছে। দুশ্চিন্তা বেড়ে যায় তখনই, যখন এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশের বাইরে থেকে গুজব ও অসত্য তথ্য ছড়িয়ে মানুষকে বিশেষ করে নারী ও শিশুদের হয়রানি করা হয়। গুজব ছড়াতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশাল জনশক্তির অপব্যবহারে ওতপেতে বসে আছে হাজারো সংঘবদ্ধ চক্র। ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার নামে বানানো স্ট্যাটাস দিয়ে হিন্দুদের নাজেহাল করার উদাহরণও কম নয়। ফেসবুকের গুজবের সূত্র ধরে ভোলার বোরহানুদ্দিনে তৌহিদী জনতা ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ, রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হিন্দুদের বাড়িঘরে আক্রমণ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা, পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননার অভিযোগে রামুর বৌদ্ধ এলাকায় তাণ্ডবসহ অনেক ঘটনা ঘটেছে। আর প্রশ্নফাঁসের মতো নানা প্রতারণা তো অহরহ ঘটছে। গুজব সমাজে বরাবরই ছিল। ফেসবুকের কারণে এখন গুজব ছড়ানো সহজ হচ্ছে।

 

বেসরকারি সংস্থা নিউজ নেটওয়ার্ক, এনগেজমিডিয়া ও ইন্টারনিউজের যৌথ আয়োজিত সাম্প্রতিক ‘ইন্টারনেট সেন্সরশিপ এবং কনটেন্ট ফিল্টারিং’বিষয়ক এক অ্যাডভোকেসি সভায় অংশগ্রহণকারী সাংবাদিক, গবেষক ও অ্যাকটিভিস্টদের আলোচনায় উঠে আসে, সরকার বারবার আশ্বস্ত করলেও বিক্ষোভ দমন, ধর্মীয় অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণ ও গুজব ঠেকাতে বাংলাদেশে ইন্টারনেট শাটডাউন, ওয়েবসাইট ব্লক, কনটেন্ট ফিল্টারিংসহ নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক চর্চা অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে একদিকে মানুষের তথ্যপ্রাপ্তি এবং ইন্টারনেটে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, অন্যদিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নেও দ্বিধাবিভক্ত হচ্ছে। গণমাধ্যমকর্মী ও অ্যাকটিভিস্টরা প্রতিনিয়ত গুজব, অসত্য তথ্য ও ঘৃণা ছড়ানোর বিপক্ষে সংগ্রাম করছেন। আমাদের বিদ্যমান আইনেই তো যে কোনো অনিয়ম ও অপরাধে বিচার হওয়া সম্ভব। তবে অফলাইন ও অনলাইনের জন্য ভিন্ন আইন কেন হবে?

এ দেশে উদীয়মান খাত অনলাইনে সেবাদানকারী স্টার্টআপে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইন নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। আর এ বিনিয়োগকারীরা বেশিরভাগই পশ্চিমা বিশ্বের। তাদের বিনিয়োগের কারণে অনলাইনে সেবা পাচ্ছে এ দেশের কোটি মানুষ। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস স্পষ্টই বলেছেন, উপাত্ত সুরক্ষা আইন উপাত্ত স্থানীয়করণের প্রয়োজনীয়তা কঠোরভাবে অনুসরণের শর্ত দিয়ে অনুমোদন করা হলে কিছু মার্কিন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বাজার ছেড়ে যেতে বাধ্য হতে পারে। একইভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে যদি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহারকারীদের তৈরি করা কনটেন্ট বা বিষয়বস্তুর কারণে অপরাধের দায় নিয়ে ফৌজদারি আইনের মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে তারা এখানে তাদের ব্যবসায় আর বিনিয়োগ করবে না। এর পরিণতি বাংলাদেশের জন্য খুবই নেতিবাচক হবে।

অনলাইন ও অফলাইন দুই ক্ষেত্রেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, এখন ডিজিটাল মাধ্যম এত বেশি শক্তিশালী যে, নিষিদ্ধ বা সীমাবদ্ধ করে কোনো কিছুই রুখে দেওয়া যায় না। বরং একটা বন্ধ করা হলে আরও দশটা সাইট খুলে খ্যাপাটে আক্রমণ বাড়তে থাকবে। সবকিছু রুদ্ধ করে দিলে তাতে চাপা ক্ষোভ বাড়তে থাকে। ছোট ছোট ক্ষোভ বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ার আগেই সমালোচনা ও ভিন্নমত সহ্য করার মানসিকতা তৈরি করা ছাড়া বিকল্প দেখছি না।

লেখক : সাংবাদিক